চমেকে ক্যান্সার হাসপাতাল না করে উন্মুক্ত জায়গা করা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলতে যে পরিবেশ থাকা দরকার তা চমেকে নেই। তাই কলেজ ক্যাম্পাসের স্থাপন করা হলে প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলতে বিকল্প ভাবনা উচিত সংশ্লিষ্টদের। তাছাড়া প্রস্তাবিত স্থানে ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলা হলে কলেজ ভবনসহ নষ্ট হবে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় আগের মাস্টারপ্ল্যানও। ফলে ভবিষতে কলেজ সম্প্রসারণেও ব্যাঘাতের পাশাপাশি নষ্ট হবে পরিবেশও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চমেক হাসপাতাল এলাকার মধ্যেই রয়েছে নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার। তাতেও ভারি রেডিয়েশনযুক্ত যন্ত্রাংশ স্থাপন আছে। তার সাথে বর্তমান রেডিও থেরাপিতেও আছে এমন যন্ত্র। এরমধ্যে নতুন করে যদি একই স্থানে আরও ভারি এসব যন্ত্র স্থাপন করা হয়, তাহলে পুরো হাসপাতালেই ডেঞ্জার জোনে পরিণত হবে।
চিকিৎসকদের মতে, এর থেকে বাতাসের বাধাহীন চলাচল কমে গুমট অবস্থা, যা ইনফেকশন ও অন্যান্য রোগ এবং জটিলতার কারণও হতে পারে। কনজেস্টেট স্থাপনা রোগীদের মানসিক ভাড়াক্রান্ত করে তুলতে পারে। তাই এসব ডেডিকেটেড হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রশস্ত জায়গা। যেখানে কোলাহল মুক্ত পরিবেশ থাকবে।
মেডিকেল কলেজ এলাকার বাইরে হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
কানাডায় কর্মরত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ডালহৌসি ইউনিভার্সিটি।
ক্যান্সার হাসপাতাল এর ভেতরে যেমন প্রশস্ত জায়গা দরকার ঠিক তেমনিভাবে হাসপাতাল এর আশেপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা অবশ্যক। প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম ক্যানসার হাসপাতাল পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচশ থেকে এক হাজার লোকের সমাগম হবে। এত লোকের গাড়ি পার্কিং, রোগী ড্রপ অফ করা এবং কেন্দ্রে অবস্থানের সময়সীমা কমপক্ষে ৪-৫ ঘণ্টা তো হবেই। কারণ রোগীদের রেডিও থেরাপি শেষ করে সেন্টার থেকে বের হতে ১-২ ঘণ্টা সময় লাগবে। কেমোথেরাপি শেষ করতে ৪-৬ ঘণ্টাও লাগতে পারে। এ সকল কারণে মূল ক্যান্সার সেন্টারের বাইরে রোগীর স্বজন/ড্রাইভারদের জন্য ওয়েটিং এরিয়া, পার্কিং এরিয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল থাকে। সুতরাং সেন্টারের দরজার সামনে প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে, যাতে করে রোগীকে গাড়ি থেকে নামালে সহজে হেঁটে ট্রিটমেন্ট এরিয়াতে যেতে পারে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকায় এতো জায়গা নেই। যে কারণে এটি মেডিকেল কলেজ এলাকার বাইরে হওয়া যুক্তিযুক্ত।
হাসপাতালের জন্য অবশ্যই খোলামেলা জায়গা দরকার
অধ্যাপক ডা. খন্দকার এ কে আজাদ
সাবেক বিভাগীয় প্রধান
চমেক সার্জারি বিভাগঃ
ঝুঁকি রোধে হয়তো ব্যবস্থা নেয়া যাবে, তাতে সমস্যা নেই। আমাদের এখনকার অবস্থার কথা ভাবলে হবে না, অন্তত কমপক্ষে আগামী ২০ থেকে ৫০ বছর পর কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। ৫০ বছর পর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে যাবে, কি হবে- সে বিষয়টিও পরিকল্পনায় রাখতে হবে। তাছাড়া বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই খোলামেলা জায়গা দরকার। ভালো জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে ডেডিকেটেড ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে ভাল উপায়। শহরের ভেতরেই হতে হবে বিষয়টি এমন নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এসব নিয়ে আরও ভাবেন, তাহলে বিষয়টি চট্টগ্রামের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কলেজের এরিয়ার মধ্যেই একের পর এক হাসপাতাল বা ইউনিট গড়ে তোলা হলে এটা ভবিষ্যতে পরিবেশ ঘিঞ্জি হয়ে যাবে। ফলে ভবিষ্যতেও কোনোকিছুর সম্প্রসারণ করা যাবে না। ২০ বছর আগের আর এখনকার মেডিকেল কলেজ কিন্তু এক নয়। জোড়াতালি দিয়ে যদি আরও সম্প্রসারণ করা হয়, তাহলে সেটাতো ভবিষৎ পরিবেশ খারাপ হয়ে দাঁড়াবে।’
নষ্ট হয়ে যাবে মেডিকেল কলেজের মাস্টারপ্ল্যান
অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস
সাবেক অধ্যক্ষ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
‘হাসপাতালে আগত রোগী বহনকারী গাড়ি, ডাক্তারদের গাড়ি- সব মিলিয়ে এটুকু রাস্তায় প্রায় সারাদিন জ্যাম লেগে থাকে। সকল স্থাপনা নির্মাণ শেষ হলে যে পরিমাণ বাড়তি লোকজন ও যানবাহন সমাগম হবে, তারজন্য পর্যাপ্ত স্থান কি সংকুলান হবে? কলেজের মাস্টারপ্ল্যান নষ্ট হয়ে যাবে এবং বিভাগসমূহের স্থানান্তরের ভারে সমন্বয় ও পরিপূরকতা বিঘœ হবে। রাজধানীতে ক্যান্সার, ইএনটি, কিডনি, নিউরো বা অর্থোপেডিকসহ একাধিক বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু তা তো ঢাকা মেডিকেল কলেজকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা আগে পূরণ করা প্রয়োজন।’
ক্যান্সার হাসপাতাল হোক লোকালয় থেকে দূরে
প্রফেসর ডা. এল এ কাদেরী।
নিউরো সার্জন ও সাবেক সভাপতি
চমেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সমিতিঃ
‘ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে আরও তীব্র হবে। এ অঞ্চলে ক্যান্সার হাসপাতাল বহু আগেই প্রয়োজন ছিল। দেরিতেই যেহেতু হচ্ছে, তবে তা স্থাপনের আগে অবশ্যই বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে গড়তে হবে। একটা হাসপাতাল গড়তে হবে বলে তড়িঘড়ি করাটা মোটেও ঠিক হবে না। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। তাছাড়া একটা হাসপাতালের মূল হচ্ছে কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমনভাবে প্ল্যান করা হয়েছে, একটার সাথে আরেকটার কোন সমন্বয় নেই। মেডিকেলের ভেতরই করতে হবে, বিষয়টি এমনও নয়। সবকিছুই কি কুঁড়েঘরের মতো থাকবে? যে হারে রোগী বাড়ছে, তার জন্য বড় স্পেস নিয়ে হাসপাতাল করার সময় চলে এসেছে। বায়েজিদসহ শহরের আশপাশেই যথেষ্ট জায়গা আছে, লোকালয় থেকে দূরের ওইসব স্থানেই গড়ে তোলা হোক ক্যান্সার হাসপাতাল।